নিউজ ডেস্ক , ২০ নভেম্বর : “ছট পুজো কি ? বৈদিক যুগ থেকে সূর্যদেবতার পুজো চলে আসছে। ছট পুজো হল আসলে সূর্য পুজো। যদি সূর্যেরই পুজো হয় তবে এর নাম কেন ছট পুজো হল জানেন কি ? ছট বা ছঠ, ষষ্ঠী নামের অপভ্রংশ। মূলত সূর্য ষষ্ঠী ব্রত হওয়ার দরুণ একে ছট বলা হয়। কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে দীপাবলি পালনের পর এই চার দিনের ব্রতের (কার্তিক শুক্লা চতুর্থী থেকে কার্তিক শুক্লা সপ্তমী) সবচেয়ে কঠিন ও তাৎপর্যপূর্ণ রাত্রি হল কার্তিক শুক্লা ষষ্ঠী। বিক্রম সংবতের কার্তিক মাসের শুক্লা ষষ্ঠী তিথিতে এই ব্রত উদযাপিত হওয়ার কারণে এর নাম ছট রাখা হয়েছে।
এই পুজোর উৎপত্তি কবে কখন কিভাবে হয়েছিল তার কোনো স্পষ্ট নিদর্শন পাওয়া না গেলেও কিছু পৌরাণিক আখ্যানে ছট পূজার নীতি নিয়মের সঙ্গে মিল থাকা উৎসব দেখা যায়। ঋগ্বেদের শ্লোকসমূহে সূর্য্যবন্দনার স্পষ্ট নিদর্শন আছে। ভারতীয় সভ্যতার সঙ্গে গ্রীক, রোমান, মিশরীয় ইত্যাদির সভ্যতাসমূহেও সূর্য্য মূখ্য দেবতা ছিলেন। সেভাবে ঊষাও বৈদিক দেবী। বেদে উল্লেখ থাকা মতে, তিনি হলেন পূর্বের দেবী এবং অশ্বিনীকুমারদের মাতা। অগ্নি, সোম এবং ইন্দ্র ইত্যাদি দেবতা সকলের পরে তিনি হলেন অন্যতম উল্লেখযোগ্য বৈদিক দেবী। রাত্রি হল তার ভগ্নী যাকে হয়তো পরে পৌরাণিক যুগে সন্ধ্যা এবং ছায়ারূপে কল্পিত করা হয়েছে। রামায়ণে উল্লেখ থাকা মতে, রামের কুলদেবতা সূর্য্যের জন্য রাম এবং সীতা এই পূজা করেছিলেন। মহাভারতে উল্লেখ থাকা মতে, দ্রৌপদী ধম্য ঋষির উপদেশ মতে সূর্য্যকে আরাধনা করে অক্ষয় পাত্র লাভ করেছিলেন। সঙ্গে মহাবীর কর্ণের কোমর পর্যন্ত জলে নেমে সূর্য্যের উপাসনা করা উল্লেখ আছে। আজও ছট পূজা উদযাপন করা সকল মানুষকে কোমর পর্যন্ত জলে নেমে সূর্য বন্দনা করতে দেখা যায়। অন্য এক আখ্যান মতে, পাণ্ডু ঋষি হত্যার পাপের প্রায়শ্চিত্তের কারণে পত্নী কুন্তীর সঙ্গে বনে থাকায় পুত্র প্রাপ্তির জন্য সরস্বতী নদীর পারে সূর্য্য উপাসনা এবং ব্রত করেছিলেন।
পুরাণ মতে, প্রথম মনু প্রিয়বতের কোনো সন্তান ছিল না। তাই তার পিতা কাশ্যপ মুনি পুত্রেষ্ঠী যজ্ঞ করতে পরামর্শ দেন। এর ফলে তার পত্নী মালিনী একটি মৃত পুত্র জন্ম দিলেন। মৃত শিশু দেখে তারাও বিলাপ করতে থাকায় আকাশ থেকে এক দিব্য কন্যা প্রকট হলেন। তিনি নিজেকে ব্রহ্মার মানস পুত্রী বলে পরিচয় দিলেন এবং মৃত পুত্রকে স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে সে জীবিত হয়ে উঠল। এখনও ঊষা দেবী বা ছটি মায়ের মূর্তি কোলে কিছু থাকা অবস্থায় কল্পনা করা হয় এবং পুত্র প্রাপ্তির জন্য ব্রত উপাসনা করা হয়। তদুপরি লৌকিক দেবী হিসাবে অন্য বহু লোককথা আখ্যান হিসাবে মানুষের মুখে মুখে চলে আসছে। ভারতে সূর্য উপাসনার জন্যে প্রসিদ্ধ পার্বণ হল ছট পূজা। এটি বছরে দুবার পালিত হয় — প্রথমবার চৈত্র মাসে যা চৈতী ছট নামে পরিচিত এবং দ্বিতীয়বার কার্তিক মাসে, যাকে কার্তিকী ছট বলে। পারিবারিক সুখ-সমৃদ্ধি তথা মনোবাঞ্ছিত ফল লাভের জন্য এটি পালন করা হয়। নারী-পুরুষ সমানভাবে এই উৎসবে অংশগ্রহণ করেন।
ছট পূজায় কোনো মূর্তি উপাসনার স্থান নেই। এতে ডুবিত এবং উদিত সূর্যকে পূজা করা হয়। আজকাল পূজা অনুষ্ঠিত করা কমিটিগুলিকে সকল ঘাটের কাছে সূর্য এবং ঊষার মূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে দেখা যায়। পূজার দুদিন আগে লাউ ভাত এবং একদিন আগে খির ভাত খাওয়ার সঙ্গে ৩৬ ঘণ্টার এক কঠোর ব্রত পালন করতে হয়। পূজায় সম্পূর্ণ সাত্বিক নৈবেদ্য ইত্যাদি কুলো, ডলা বা পাচিতে রেখে উৎসর্গ করা হয়। বিভিন্ন ফলমূল, মিঠাই ইত্যাদির সঙ্গে পরম্পরাগত বিহারী লোকখাদ্য ঠেকুয়া প্রস্তুত করে নৈবেদ্যরূপে প্রদান করা হয়। এই সময় নুন-মশলাবর্জিত সম্পূর্ণ নিরামিষ খাদ্য গ্রহণ করা হয়। পূজার শেষে আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীদের প্রসাদ বিতরণ এই পূজার অন্যতম নিয়ম। এই পূজায় অনেককে বাগরি নদীর ঘাটে গিয়ে পূজা করার দৃশ্যও দেখতে পাওয়া যায়। বর্তমানে এই পূজা এক সার্বজনীন রূপ পেয়েছে। বিভিন্ন ভাষাভাষী, ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষ এই পূজার মাহাত্ম্য উপলব্ধি করে পূজায় সামিল হতে শুরু করেছেন।
যাঁরা ছট পুজো করে থাকেন , তাঁরা ভাইফোঁটার পর থেকেই টানা নিরামিষ খান। এই নিরামিষে পেঁয়াজ রসুনও জায়গা পায় না। পুজোর দু’দিন আগে লাউয়ের যেকোনও পদ খেতে হয়। পুজোর ঠিক আগের দিন ‘’ খারনা ‘’ নামের একটি নিয়ম পালিত হয়। এই সময় সূর্যদেবের উদ্দেশ্যে পায়েস , লুচি , কলা অর্পণ করা হয়। নিঃশব্দ ঘরে এই পুজো হয়ে থাকে। পুজোর শেষে প্রসাদ সকলে ভাগ করে খান। ব্যস এই পর্যন্তই। এরপর চলে নির্জলা উপবাস। ছট পুজোর দিন সূর্যাস্তের সময় পড়ন্ত সূর্যকে উদ্দেশ্য করে নদীতে কোমর জলে নেমে পুজো সারেন ভক্তরা। সূর্যদেবের উদ্দেশ্যে এই পুজো বলে, সূর্য ওঠার মুহূর্ত ও সূর্য ডোবার মধ্যে শেষ করতে হয় পুজো।
ছট পুজোর ডালাতে থাকে হলুদ গাছ , আম পল্লব , নারকেল , কলার কাঁদি , বিভিন্ন ফল , ঠেকুয়া ও খাস্তা টিকরি। নদীর ঘাটে বসে একমনে সূর্যদেবের আরাধনা করার পর নামতে হয় কোমর জলে। নদীর বুকে দাঁড়িয়ে পুজোর ডালা সূর্যদেবের উদ্দেশ্যে অর্পণ করে , ধূপ ধুনো দেখিয়ে হয় আরতি। অবশেষে পরিবারের সকলের নাম করে একটা একটা করে প্রদীপ ভাসিয়ে দেওয়া হয় নদীর বুকে। এটাই এই পুজোর নিয়মরীতি। ডালার প্রসাদ বাড়িতে নিয়ে যান সকলে। বাড়ি ফেরার পরও কিন্তু উপোস ভাঙা হয় না। পরের দিন ভোরে আরও একবার সূর্য পুজোর জন্য ঘাটে যেতে হয়। যাঁরা মানত করেন তাঁরা বাড়ি থেকে ঘাট পর্যন্ত দণ্ডি কাটেন। এই পুজো বেশ দুরূহ। গোটা একটা দিন নির্জলা উপবাস থাকা সবার জন্য মুখের কথা নয়। এমনকি দণ্ডি কাটাও বেশ কষ্টকর। অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালিত হয় ছট পুজো। ছট পুজোর শেষ দিনে ‘’ মৎস্যমুখী ‘’ অনুষ্ঠান হয় অনেক পরিবারে। পৌরাণিক মতে ছট পুজো একাধারে সূর্যদেব , মা অন্নপূর্ণা ও গঙ্গাদেবীর পুজো। এ পুজোর পিছনে একটি সামাজিক কারণও আছে। বৃষ্টি না হলে প্রখর তাপে মাঠ শুকিয়ে যেত। ফসল হত না। সেজন্য সূর্যদেবকে তুষ্ট করতেই এই পুজোর শুরু বলে একটি কাহিনি প্রচলিত আছে। সূর্যদেব তুষ্ট হলে মাঠঘাট , খালবিল শুকবে না। মাঠে ফসল ফলবে। অনেকের বিশ্বাস, ছট পুজো করলে সূর্যদেবের প্রত্যক্ষ উপস্থিতি জীবনে বিঘ্ননাশ করে , দুঃখনাশ করে, সুখ ও অর্থ-বৈভব আনে। সূর্যের কিরণে এই জগৎ আলোকিত। পৃথিবীতে প্রাণের সঞ্চার সূর্যালোকের জন্যই। সূর্যদেবের উদ্দেশ্যে কার্ত্তিক মাসে ছ’ দিনব্যাপী উৎসব ছট পুজো সারা বিশ্বে পালিত হয় তাঁকে তুষ্ট রেখে জগৎ সংসারের সার্বিক মঙ্গলের কামনায়।