নিউজ ডেস্ক, শাশ্বতী চক্রবর্তী : কুসংস্কার হল মনুষ্যের যুক্তি-বিচার বিশ্লেষণহীন এক অন্ধবিশ্বাস যার মূল ভিত্তি কল্পিত ধারণা। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় Superstitions । এগুলি সম্পূর্ণরূপে ভন্ড কার্যকারণ সম্পর্ক হীন। সে কারণেই *বারট্রান্ড রাসেল (Bertrand Russell)* কুসংস্কারের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন-
*”Fear is the main source of superstition, and one of the main sources of cruelty. To conquer fear is the beginning of wisdom”.*
কুসংস্কার টিকে থাকে শুধুমাত্র মানুষের বিশ্বাসের কারণে। কেননা, যুক্তি দিয়ে বিচার করলে কিংবা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে দেখা যায়, কুসংস্কারের আসলে কোনো ভিত্তি নেই। মানুষ তার অমঙ্গলের ভয়ে ভীত হয়ে বিভিন্ন হাস্যকর বিষয়কেও বিশ্বাস করে মেনে চলে। তাদের অন্ধ বিশ্বাসই কুসংস্কারকে অন্য সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেয় এবং বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ সেগুলোকে প্রচলিত রাখে। কুসংস্কারে বিশ্বাসী মানুষের কুসংস্কারের প্রতি বিশ্বাস এত দৃঢ় হয় যে তারা কুসংস্কারগুলোকে অবশ্য পালনীয় কর্তব্য বলে মনে করে। কোনো রকম চিন্তা বা বুদ্ধি-বিবেচনা দিয়ে বিচার করা ছাড়াই তারা কুসংস্কারের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস স্থাপন করে।
কুসংস্কার বা Superstition হল অযৌক্তিক যেকোনো বিশ্বাস বা অভ্যাসকে বোঝায়।
তবে বছরের পর বছর এমন অনেক কিছুই আমরা মেনে আসছি যার হয়তো যথাযথ ব্যাখ্যা দিতে না পারলেও তার পেছনে লুকিয়ে রয়েছে অনেক যুক্তিযুক্ত কারণ।
যেমন –
১. *ভাঙ্গা আয়নায় মুখ দেখা* – আয়না আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলোর মধ্যে একটি। সারাদিনে একবারও আয়না দেখেন না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু এই আয়নাকে ঘিরে রয়েছে নানান কুসংস্কার। বিশেষ করে ভাঙ্গা আয়নায় মুখ দেখা নাকি অশুভ। ভাঙ্গা আয়নায় মুখ দেখলে নাকি বাড়ির অমঙ্গল হয়৷ অসুস্থ হতে পারেন পরিবারের প্রিয় জন৷ আসল কারণ হলো, ভাঙ্গা আয়না বাড়িতে থাকলে যে কোনও সময় দুর্ঘটনা বশত হাত কেটে যাওয়ার আশংঙ্কা থাকে৷
২. *যাত্রা কালে হাঁচি* – হাঁচি কে না দেয়? সবাই হাঁচি দেয়। বিভিন্ন ধরন ও মাত্রার হাঁচির সঙ্গে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত, আর তা আমাদের জীবনের সঙ্গে নানাভাবে জড়িত। হাঁচি নিয়েও কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে। হাঁচি দিলে নাকি যাত্রা অশুভ হয়। আর সেজন্যই নাকি অশুভ বিষয়কে ঠেকাতে হাঁচি দিলে বলা হয় “ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুন” বা “God bless you” কথাটি। এগুলো সবটাই ভ্রান্ত ধারণা। ধুলো, জীবাণু, অ্যালার্জেন নাকে এসে ঢুকলে শুরু হয় হাঁচি। উদ্দেশ্য বস্তুটিকে বের করে দেওয়া।
ভাইরাস সংক্রমণ অর্থাৎ সাধারণ ফ্লু, ইনফ্লুয়েঞ্জা,
অ্যালার্জি। বিষয়টি খানিকটা জন্মগত, কিছুটা পরিবেশ গত। দীর্ঘদিন কোনও রাসায়নিক, ধুলো বা গন্ধের মধ্যে থাকতে থাকতে তাতে অ্যালার্জি হতে পারে।
আচমকা নাকে কিছু ঢুকে গেলেও হাঁচি শুরু হয়। তাই হাঁচি খুব সাধারণ একটি বিষয়।
৩. *রাতে গাছ থেকে পাতা বা ফুল তোলা* – প্রচলিত যে, রাতে গাছে ফুল তুললে বা পাতা ছিঁড়লে শারীরিক ক্ষতি হয় বা বাড়ির অমঙ্গল হয়৷ তবে এর পেছনের প্রধান কারণ হল, রাতে গাছে অনেক বিষাক্ত কীট পতঙ্গ থাকে৷ ফুল তুলতে গেলে সেগুলোর কামড়ানোর আশংঙ্কা থাকে৷ তাই গাছে হাতে দিতে বারণ করা হয়৷
৪. *সন্ধ্যের পর নখ কাটা* – সূর্যাস্তের পর নখ কাটলে, যিনি নখ কাটছেন, তার গভীর অসুখ ধরা পড়ে বলে কুসংস্কার রয়েছে৷ আসলে তা নয়। এর পিছনে আসল কারণ হল, আলোর অভাবে নখ কাটার সময়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে৷ হাত বা পা কেটে যেতে পারে ৷
৫. *কালো বিড়াল রাস্তা কাটা* – শুধু আমাদের দেশেই নয়, বিশ্বজুড়ে অনেক মানুষই কালো বিড়ালকে অশুভ মনে করেন। দুর্ভাগ্যের প্রতীক মনে করেন। প্রচলিত যত কুসংস্কার রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় এই কালো বিড়ালকে অশুভ মনে করা। আসলে, অনেক সময় বিড়ালকে তাড়া করে বড় কোনও পশু৷ যা গাড়ি বা মানুষের সামনে এসে পড়লে বড়সড় দুর্ঘটনা ঘটার আশংঙ্কা থাকে৷
৬. *যাত্রাকালে কাওকে পেছন ডাকা* – যাত্রার সময় কেউ পেছন থেকে ডাকলে, তাকে অশুভ বলে মনে করা হয়৷ এতে নাকি যাত্রা ভঙ্গ হয়। তাই কিছুক্ষণ দাড়িয়ে আবার যাত্রা শুরু করা উচিত। তবে এর পেছনের ব্যাখ্যা হল, কেউ পেছন থেকে কাওকে ডাকলে ব্যক্তির অন্যমনস্ক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে৷ ফলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে৷
৭. *জোড়া শালিক পাখি দেখা* – প্রচলিত আছে, ঘুম থেকে উঠে জোড়া শালিক দেখলে বলে সারাদিন খারাপ যায়। আসলে সেরকম কিছুই না। পাখিরা সাধারণত দলবদ্ধ হয়ে ঘুরে বেড়ায়। তাই দুটো শালিক পাখি একসাথে থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
৮. *ঘরের মেঝেতে গোবর লেপন শুভ* – গরুর অন্য যে কোনও উৎপাদনের মতো গোবর লেপনকেও পবিত্র বলে মানা হয়ে থাকে। তাই বেশির ভাগ ধর্মীয় প্রথাতেই মাটিতে গোবর লেপার প্রচলন আছে। গোবরের কটু গন্ধের জন্য কীট পতঙ্গ এবং সরীসৃপরা দূরে থাকে। আমাদের পূর্ব পুরুষেরা সম্ভবত সেজন্যই পতঙ্গ ও সরীসৃপের উৎপাত থেকে রক্ষা পেতে বাড়িঘরে গোবর লেপন প্রচলন করেছিলেন। আমাদের মতো বোতলে ভরা সংক্রমণরোধী তরল কেনার উপায় তাদের ছিল না। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই অনুশীলন একটি প্রথায় পরিণত হয়েছে এবং আজকের দিনে তা সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় হওয়া সত্ত্বেও আমরা তা মেনে চলেছি।
৯. *বাইরে যাওয়ার আগে দই চিনি খাওয়া শুভ* – ভারত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশ হওয়ায় এখানে দই বা টক জাতীয় খাবার বেশি করে খাওয়া উচিত। কারণ দই পাকস্থলীকে ঠান্ডা রাখে। কেউ কোনও গুরুত্বপূর্ণ কাজে বাড়ি থেকে বেরনোর আগে দইতে অল্প পরিমাণ চিনি মিশিয়ে খাওয়ানো হয়, যাতে চটজলদি শরীরে গ্লুকোজ তৈরি হয়। ভারতীয়দের পক্ষে এই খাদ্য অপরিহার্য হওয়ার সঙ্গে সৌভাগ্যের ধারণা যুক্ত হয়ে গিয়েছে। পরীক্ষা বা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজে বেরনোর সময় কপালে দই-এর ফোঁটা দেওয়ার প্রথাও সেখান থেকেই।
তবে জেনে রাখা উচিত, দই এর গুরুত্ব তার খাদ্যগুণে, কপালে লাগানোয় নয়।
এরকম বহু কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে, যা মানুষ কারণ না জেনেই চোখ বন্ধ করে বছরের পর বছর মেনে আসছে। সমাজের প্রচলিত সংস্কার-কুসংস্কার মানুষকে অলীক আতঙ্কে আটকে রাখে। কুসংস্কার বিশ্বাস করে কিছু ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে মানুষ বেঁচে থাকে, যেগুলো আসলে একেবারেই ভিত্তিহীন। কিন্তু বর্তমানে এই বিজ্ঞানের যুগে, তথ্য-প্রযুক্তির যুগে তা একেবারেই বেমানান। তাই বিজ্ঞান চর্চার মাধ্যমে সমস্ত কুসংস্কার থেকে মুক্ত হওয়া উচিত। সব কিছুকে বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে যুক্তি দিয়ে বিচার করলেই কুসংস্কার থেকে মুক্তি সম্ভব।