খ্যাতির আলো আঁধার
লিখেছেন : অধ্যাপক শান্তনু চট্টোপাধ্যায়
কথাতেই বলে পুরুষের ভাগ্য না–কি দেবতারও অজানা।এমন কথার নজির আছে বাংলা সাহিত্যের অনেক বিখ্যাত লেখকদের মধ্যেও। আজ বলব এমন একজন লেখকের কথা যিনি সাহিত্য রচনা করবেন বলে কলম ধরেন নাই।
তাঁর মাঙ্কে খানেওয়ালা জীবন থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতাকে মূলধন ক’রে কলম ধরে তাঁর সময়েই বিখ্যাত ও জনপ্রিয় সাহিত্যিকের মর্যদা পেয়েছিলেন।শুধু-কি জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন! সঙ্গে এসেছিল প্রভূত টাকা ও একের পর-এক বই রচনার জন্য কলেজস্ট্রিট থেকে অনুরোধও।আবার তুমুল জনপ্রিয়তা অঢেল টাকাপয়সা খ্যাতি ইত্যাদির বৃত্তকেন্দ্র থেকে ক্রমশঃ দূরে যেতে যেতে হারাতে থাকেন তাঁর খ্যাতি পরিচিতি।শেষ জীবনে নেমে আসে চরম অর্থাভাব।
ছিলেন ভবঘুরে সন্ন্যাসী।আসমুদ্র হিমাচল ঘুরেছেন।থেকেছেন জঙ্গলে শ্মশানে হিমালয়ের পথে-প্রান্তরে, এমনকি হিংলাজ যাত্রায় জীবনকে মৃত্যুর পায়ে বেঁধে হেঁটে গেছেন করাচি থেকে হিঙ্গুলায়।ভারতীয় সাধক সমাজের এটা বড় অংশের মধ্যে ভ্রষ্টাচার, পবিত্রতার আড়ালে সাধু সন্ন্যাসীর রহস্যময় জীবনকে তিনি সেই সমাজের ভেতর থেকে দেখেছিলেন।ফলে গার্হস্থ্য জীবনে এসে কাঁধের ঝুলি ও হাতের কমুণ্ডুলু ফেলে যখন তিনি সংসারের ব্যাগ আর হাতে কলম ধরলেন তখন বাঙালি পাঠক-সমাজের কাছে এক নতুন জগতের বিচিত্র স্বাদের আখ্যান একে একে উদ্ভাসিত হতে থাকল। ছিলেন ভিক্ষাজীবী সন্ন্যাসী, মাঙ্কে খানেওয়ালা এবং লোটা-কম্বল চিমটে-সম্বল এক ফক্কর তান্ত্রিক। কিন্তু, তাঁর প্রথম বই ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ প্রকাশ হতেই বাঙালি পাঠকের কাছে তুমুল চাহিদা দেখা দিল।এই বইটির চাহিদা এতখানি ছিল যে বইটির প্রকাশক সেকালে ছাপিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারতেন না।ভ্রমণের মধ্যে উপন্যাস বা উপন্যাসের মধ্যে ভ্রমণকথা মিশিয়ে গড়া এই কাহিনি অবলম্বনে বিকাশ রায় পরিচালিত ও অভিনীত ফিল্ম রিলিজ হতে আপামর বাঙালির কাছে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে উঠলেন লেখক অবধূত (০২.১১.১৯১০—১৩.০৪.১৯৭৮)। তাঁর প্রকাশিত তৃতীয় গ্রন্থটিও সেকালে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল এবং আজও পাঠকের কাছে সমানভাবে আগ্রহের হয়ে আছে সেই উপন্যাস—‘উদ্ধারণপুরের ঘাট’।
‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ সিনেমা হতে লেখক অবধূতের নাম খুব স্বাভাবিকভাবে বাঙালির মুখে মুখে ঘুরতে থাকে। তাঁর বাড়ি চুঁচুঁড়ার রুদ্রচণ্ডীমঠে আনাগোনা হতে থাকে বিখ্যাত মানুষের এবং সাধারণ দর্শনপ্রার্থীর। এই দর্শকগণের মধ্যে ছিলেন এক যুবক, যিনি পরবর্তী কালে পরিচিত হয়েছেন ‘পাণ্ডব গোয়েন্দা’র লেখক হিসেবে।
লেখক অবধূত খ্যাতির চরমতম স্থানে পৌঁছানর পর ফিরে পান তাঁর ফেলে আসা সন্তানকে।সেই সন্তানের বিয়ে দেন। সংসার বাড়ে। দুই নাতি পুত্র বউমা এবং তাঁর সাধন সঙ্গিনী ভৈরবীকে নিয়ে বেশ জমাট একটা পরিবার যখন বহমান তখন ক্রমশঃ ভাটা পড়তে থাকে তাঁর লেখার গুণগত মানে। যে সময়ের তিনি লেখক সে সময়ে বাংলা কথাসাহিত্যে একদিকে দিকপাল কথাসাহিত্যিকরা রয়েছেন, অন্যদিকে নবাগত লেখকদের মধ্যে চলছে গল্প উপন্যাস নিয়ে নিত্যনতুন পরীক্ষা নিরীক্ষা। কিন্তু অবধূত রয়ে গিয়েছিলেন তাঁর সেই আত্মজৈবনিক অভিজ্ঞতার মোহে। ফলে,গল্প উপন্যাস তাঁর প্রকাশ পাচ্ছিল ঠিকই কিন্তু পাঠক চাহিদা আর আগের মত থাকে নাই। অন্যদিকে, লেখকের সাংসারিক খরচের বহড় বেড়ে যাচ্ছে।এভাবে চলতে চলতে তাঁর জীবন ঠিক সেই আগের মত হয়ে ওঠে। যেরকম আর্থিক অবস্থায় শুরু করেছিলেন লেখালেখি ঠিক সেরকম এক পরিস্থিতির মধ্যে তাঁর জীবনাবসান ঘটে।