নিউজ ডেস্ক, ০৩ ডিসেম্বর : ‘আমায় একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি।”- ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে জীবনের বিদায় মুহূর্তে এই জয়গান গেয়েছিলেন সর্বকনিষ্ঠ বাংলার বিপ্লবী শহিদ ক্ষুদিরাম বসু। ফাঁসির আগে কারা কর্তৃপক্ষ তাঁর কাছে শেষ ইচ্ছা জানতে চাইলে নির্ভিক চিত্তে সেই মহান বিপ্লবী বলেছিলেন আমি ভালো বোমা বানাতে পারি, মৃত্যুর আগে সারা ভারতবাসীকে তা শিখিয়ে দিয়ে যেতে চাই।
একথা শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন কারা রক্ষীরা। বাংলার অগ্নিযুগের সেই মহান বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুর জন্ম ৩ ডিসেম্বর ১৯৮৯ সালে। মেদিনীপুর শহরের কাছাকাছি (বর্তমান পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা) কেশপুর থানার অন্তর্গত মৌবনী (হাবিবপুর) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ত্রৈলোক্যনাথ বসু ছিলেন নাড়াজোলের তহসিলদার। তাঁর মা ছিলেন লক্ষ্মীপ্রিয় দেবী। তিন কন্যার পর তিনি ছিলেন তাঁর মায়ের চতুর্থ সন্তান। জন্মের পরই ছেলে মারা যাবে এই অন্ধবিশ্বাসে তাঁর মা তিন মুঠো খুদের বিনিময়ে তাঁকে বিক্রি করে দিয়েছিলেন মাসির কাছে। সেই থেকেই তাঁর নাম হয় ক্ষুদিরাম। মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই মাকে হারান ক্ষুদিরাম। তার এক বছর পর তাঁর বাবারও মৃত্যু হয়। তখন তাঁর বড়ো দিদি অপরূপা তাঁকে দাসপুর থানার এক গ্রামে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান লালন পালনের জন্য।অপরূপার স্বামী অমৃতলাল রায় ক্ষুদিরামকে তমলুকের হ্যামিল্টন হাইস্কুলে ভরতি করে দেন। এরপর শ্রীঅরবিন্দ এবং সিস্টার নিবেদিত মেদিনীপুরে এসে স্বাধীনতার লড়াইয়ে নামার জন্য বিপ্লবী সংগঠনগুলিকে আহ্বান জানান। তাদের সঙ্গে গোপন বৈঠকও করেন। তখন কিশোর ক্ষুদিরাম এই সমস্ত বিপ্লবীদের বিট্রিশ বিরোধী আন্দোলনে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি অনুশীলন সমিতিতে যোগদান করেন। দলের কাজকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য তাতশালা স্থাপন করেন। এই তাতশালার পিছনে লাঠিখেলা, তরবারী চালান, বোমা তৈরী, পিস্তল বন্দুক ছোড়ার শিক্ষা হত। দ্রুত এসব বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠেন ক্ষুদিরাম। দেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ের জন্য দিদির বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন একদিন। রাজনৈতিক নিষিদ্ধ পত্র-পত্রিকা বিলি করার জন্য পুলিশ ধরতে গেলে তাদের হাত পালিয়ে যান। পরে ধরা পড়লে নাবালক হওয়ার কারণে পুলিশ মামলা প্রত্যাহার করে নেয়। তবে লড়াই থেমে থাকে নি ক্ষুদিরামের। বিপ্লবীদের শাস্তি দিতে মরিয়া হয়ে উঠেন চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড। দলীয়ভাবে সিদ্ধান্ত হয় কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে হবে। এর দায়িত্ব দেওয়া হয় ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকীকে। সেই মতো দুই তরুণ বিপ্লবী রওনা হন মজফফরপুরে। তাঁরা গোপনে আশ্রয় নেন কিংসফোর্ডের বাসভবনের পাশের একটি হোটেলে। ১৯০৮ সালের ৩০ এপ্রিল বিহারের মুজফ্ফরপুরে ইওরোপিয়ান ক্লাবের সামনে বিপ্লবী প্রফুল্ল চাকির সঙ্গে বোমা ছুড়ে হত্যা করতে গিয়েছিলেন অত্যাচারী ব্রিটিশ বিচারক ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড সাহেবকে। কিন্তু, দুর্ভাগ্যবশত যে গাড়িটিতে তাঁরা বোমা ছুড়েছিলেন তাতে ছিলেন না কিংসফোর্ড। বদলে দুই ইংরেজ মহিলার মৃত্যু হয়। প্রফুল্ল চাকি আত্যহত্য়া করলেও ক্ষুদিরাম ধরা পড়েছিলেন ব্রিটিশদের হাতে। বিচারে তাঁর ফাঁসির রায় দিয়েছিলেন ব্রিটিশ বিচারক মি. কর্নডফ। রায় ঘোষণার পর ক্ষুদিরামের মুখে ছিল হাসি। অল্প বয়সী ক্ষুদিরামকে বিচারক কর্নডফ প্রশ্ন করতে বাধ্য হয়েছিলেন, ফাঁসিতে যে মরতে হবে সেটা সে বুঝেছে তো? স্বাধীনতার স্বপ্নে এমনই নির্ভীক ছিলেন মেদিনীপুরের এই বিস্ময় যুবক।
১৯০৮ সালের ১১ অগাস্ট জেলের ভিতরে গড়া হয়েছিল ১৫ ফুট উঁচু এক ফাঁসির মঞ্চ। দুই দিকে ছিল দুটি খুঁটি। তার উপর একটি মোটা লোহার রড ছিল আড়াআড়িভাবে লাগানো। সেই রডের মাঝখানে মোটা একগাছি দড়ি বাঁধা ছিল। তার শেষ প্রান্তে ছিল মরণ-ফাঁস।ক্ষুদিরামকে সেই মঞ্চে তাঁকে নিয়ে এসেছিলেন ব্রিটিশ সরকারের চার পুলিশ। ক্ষুদিরাম ছিলেন তাঁদের সামনে। ফাঁসির আগে উপস্থিত আইনজীবীদের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলেছিলেন তিনি। তারপর পিছমোড়া করে বাঁধা হয় দুইহাত। গলায় ফাঁসির দড়ি পরানো মাত্র জল্লাদকে শহীদ শুদিরাম প্রশ্ন করেছিলেন ‘ফাঁসির দড়িতে মোম দেওয়া হয় কেন?’ এটাই ছিল বীর শহিদের জীবনের শেষ কথা। জল্লাদ বিস্ময়ে কিছু বলতে পারেননি। হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন ব্রিটিশ জেলার থেকে উপস্থিত সকলে। ফাঁসির আগে কী করে কারোর মনে এই প্রশ্ন আসতে পারে? তবে লক্ষ্মীপ্রিয় দেবী হয়ত বুঝতে পারেননি তাঁর এই ছেলে যে অন্য ধাতুতে গড়া। তাই স্বাধীন ভারতের মানুষের মনে আজও যিনি অমর হয়ে রয়েছেন। তাঁর জন্মদিনে রইল বিনম্র শ্রদ্ধা আর সি টিভির পক্ষ থেকে৷