নিজস্ব সংবাদদাতা , মালদা , ০৮ নভেম্বর : মালদা শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে পুখুরিয়া থানার আরাইডাঙ্গা গ্রামপঞ্চায়তের অন্তর্গত গোবরজনা গ্রাম। সেখানেই অবস্থিত কালিমন্দির। প্রতিবছর ভক্তি নিষ্ঠার সাথে পূজা হয়ে আসছে এখানে। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লক্ষাধিক ভক্তেরা এই পুজোয় ভিড় জমান। মায়ের মন্দির সংলগ্ন কালিন্দ্রি নদীর তীরে বিশাল মেলা বসে পূজার কটা দিন। তবে এবছর করোনা আবহে শুধুমাত্র নিয়ম রীতি মেনেই আয়োজিত হবে পুজো।
এলাকার প্রবীণদের মুখে জানা যায়, গোবরজনা কালীপূজা ডাকাতদের হাতে সৃষ্টি। ডাকাতেরা শক্তির আরাধোনায় মা কালীর পুজো এই এলাকায় আরম্ভ করে। প্রায় ৩৫০ বছর ধরে এই ডাকাতের হাতে সৃষ্ট এই পুজো আজও একই নিয়ম রীতি মেনে পুজো হয়ে আসছে। পুখুরিয়া, আরাইডাঙ্গা সহ সমগ্র এলাকা ঘনজঙ্গলে ঢাকা ছিল। সেসময় ঘনজঙ্গলে হিংস্র পশুও বাস করতো। তাই মানুষের আনাগোনাও এলাকায় কম ছিল। সেই সুযোগে বিহার থেকে একদল রাজপুত নদীপথে এসে এই জায়গায় বসবাস শুরু করে। এই রাজপুত মানুষদের পেশা ছিল ডাকাতি করা। এখান থেকেই বিভিন্ন প্রান্তে ডাকাতি চালাতো। ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে ও ডাকাতি করে ফিরে এসে শক্তির আরোধনার জন্য মা কালীর পুজো করতেন ডাকাতরা। কার্তিক মাসে ডাকাতেরা নিজেরাই মায়ের প্রতিমা তৈরি করে পুজো করতো। আর সেই থেকেই এই পুজো একই রকম ভাবে হয়ে আসছে।
চৌধুরী পরিবারের এক সদস্য শান্তি চৌধুরী জানান, “জেলার প্রাচীন ও শ্রেষ্ঠ পুজোর মধ্যে অন্যতম এই পুজো। এলাকাবাসী ও পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতায় এই পুজো, মেলা, বলি, নিরঞ্জন সমগ্রই শান্তিপূর্ণ সম্পন্ন হয়ে থাকে। পুজোর সময় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় এলাকার মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষেরা। মায়ের প্রচুর অলংকার রয়েছে। পুজোয় প্রচুর দান করে মানুষ। তাই পুজোর বাজেটে অসুবিধে হয় না। প্রাচীন রীতিনীতি মেনেই একই মতো পুজো হয়ে আসছে আজও। তবে এ বছর একটু আলাদা পরিস্থিতি রয়েছে। তাই মন্দির প্রাঙ্গণে মাস্ক, স্যানিটাইজার সর্বত্র সর্তকতা অবলম্বন এর উদ্যোগ রয়েছে। এত বড় পুজোর সাথে মেলা তাই পুলিশ প্রশাসনের তরফ থেকে এই পুজোকে কেন্দ্র করে নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে ফেলা হয় গোটা এলাকাকে। তবে বর্তমানে নেই জঙ্গল, নেই ডাকাত। গড়ে উঠেছে ছোট ছোট গ্রাম। এলাকার এক চৌধুরী পরিবার বংশপরম্পরায় এই পুজো চালিয়ে আসছে। স্থানীয় জ্যোতিষ চৌধুরীর পরিবারের বংশধররা বর্তমানে এই পুজোর দায়িত্ব থাকলেও এলাকাবাসী ও পুলিশ প্রশাসন সমগ্র দায়িত্ব ভার সামলে থাকেন। এই পুজোতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সহযোগিতা করে এলাকার মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষজন। পুজোর কটা দিন মায়ের আরাধনা মত্ত থাকে গোটা এলাকা। বর্তমানে জ্যোতিষ চৌধুরীর পৌত্ররা বংশপরম্পরায় এই পুজো পরিচালনা করে আসছে। দানের দেড় বিঘা জমির উপর মায়ের স্থাপিত মন্দির রয়েছে।
এই পুজো নিয়ে এলাকায় কান পাতলে শোনা যায়, সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দেবী চৌধুরানী’ উপন্যাসের নায়ক ভবানী পাঠক ও দেবী চৌধুরানীর স্মৃতি রয়েছে এই পুজোয়। কথিত আছে সেসময় ভবানী পাঠক ও দেবী চৌধুরানী বজরা করে রাতে নদীপথে উত্তরবঙ্গের দিকে যাওয়ার পথে নদীতে বজরা আটকে পড়ায় এই গোবরজনা কালি মন্দিরে রাত্রিযাপন করেছিলেন। তারপর মায়ের স্বপ্নাদেশ পেয়ে মায়ের পুজো দিয়েছিলেন তারা। তারপর তাদের বজরা চলতে আরম্ভ করে। তবে এখনো এই পুজোকে ভবানী পাঠকের পুজো বলে আখ্যা দিয়ে থাকেন অনেকেই। আবার কেউ তা মানতে নারাজ। কারণ, গল্পের নায়ক বাস্তবে কি করে আসবে। তবে যত দিন যাচ্ছে এই পুজো ও মায়ের প্রতি বিশ্বাস বেড়েই চলেছে ভক্তের। বিহার, ঝাড়খন্ড এমনকি প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ ও নেপাল থেকে ভক্তরা মায়ের পুজো দিতে ভিড় জমান এই মন্দিরে। প্রতিবছর প্রায় ৫ হাজার পাঠা বলি হয় মায়ের কাছে। বছরের প্রত্যেক মঙ্গল ও শনিবার প্রচুর ভক্তের সমাগম হয় মন্দির প্রাঙ্গণে। মন্দিরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কালিন্দ্রি নদীতে মায়ের প্রতিমা বিসর্জন করা হয় পুজোর পরের দিনই। তবে এই বছর অতিমারি করোনার দাপট রয়েছে। উৎসব পালনের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক নির্দেশিকা রয়েছে। যদিও কোনরকম ভিড় না হয় সেদিকে তৎপর থাকছে প্রশাসন, এমনটাই জানা গেছে। সাথে সাথে পুজোকে ঘিরে রয়েছে সতর্কতা। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে প্রশাসনিক কর্তারা আলোচনার মধ্য দিয়ে সমগ্র দিক নির্ধারণ করবেন বলে জানিয়েছেন তারা।