fbpx

উদ্ধারণপুরের শ্মশানে জ্বলন্ত চিতায় দাঁড়িয়ে উঠলো বামুন ঠাকমা। পড়ুন “অবেলা কালবেলা”

শান্তনু চট্টোপাধ্যায় : সাল ১৯৮৯। মাঘ মাস। শীতের হিম হিম দুপুর গড়িয়ে ঝুপ করে সন্ধ্যাবেলা ডুব দিল মজুমদারপকুরের পাকুড়তলায়। সেখানে জমা ছিল সামান্য পাতার মতো কালো মেশানো হলুদ আলো। চক্রবর্তীদের ঠাকমা ঠিক তখনই শেষতক ডুব দিল গাঢ়ঘুমে। আর উঠল না।
শরৎকাল থেকে ঠাকমার হাতের লাঠি শুয়ে ছিল ওঁর বিছানার পাশে। মাটির ঘরের বারান্দায় থাকতেন দিনে। রাতে ঘরের ভেতর বিছানাসহ তুলতে হত।তখন ৯৯ বচ্ছর বয়েস।
সমস্যাটা হলো তারপর।কারণ,একে হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডা,তাতে একদিন আগেই হয়েছে বৃষ্টি। আকাশে মেঘের যাতায়াত আছেই। এদিকে ঠাকমার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য যেতে হবেই ‘যত মড়া উদ্ধারণপুরের ঘাটে’। ঠাকমার নাতি, হারু কিছু জোওয়ান ছোকড়া বন্ধুকে বলেছে বটে কিন্তু, ক’জন আসবে সেটা ভাবনার। ওদিকে, পাড়ার মুরুব্বি গোছের দু’চারজন না হলে চলবে না। কারণ, শ্মশানে পৌঁছাতে রাত হবে। তারপর দাহকাজ সেরে উঠতে সকাল হতে পারে।সঙ্গে আছে হেঁটে এতটা পথ যাওয়া। ফাঁকামাঠে উত্তুরে হাওয়া,গঙ্গার ঠাণ্ডা হাওয়া এবং সে অবস্থায় বলির পাঁঠার মতো গঙ্গাস্নান! আর যেটা বলতে হয় না সেটা — রাতের বেলায় উদ্ধারণপুরের শ্মশান! জেনেবুঝে ভূতের সাক্ষাতে যাওয়া! এসব ভেবে-চিনতে দেখতে গেলে কেঁধোর সংখ্যা স্বাভাবিকভাবেই কম হবে। তা বুঝেছে হারু।

‘অবেলায় মরলে এরকমই হয়’ ঘাটের মড়া সুবল নাপিত এসব বলে চলে গেল। বুড়ো মানুষ তো সুবল নাপিত, তাই নিজেকেই হয়তো বলতে বলতে চলে গেল। তার কালের কেউ আর বেঁচে নাই এ গ্রামের।শেষ ছিল এই বামুন ঠাকরুণ। শেষপর্যন্ত জনা-বারো ছেলেপুলে আর একজন মাত্র মাঝ বয়সি মিলে ‘বল হরি’—‘হরি বোল’ ধ্বনি যখন তুলল গ্রামে, তখন গাঁয়ের কোনো বাড়ির লোক সে শব্দ শুনেও বেরুবার অবস্থায় ছিল না। গ্রামের উত্তরে ঘরবাড়িঘেরা পথ ছাড়তে নেমে এলো ঘন কুয়াশামোড়া ফাঁকা মেঠোপথ। হু হু ঠাণ্ডা হাওয়ায় শিশিরভেজা মাটিতে পা রাখা দায়। বারোজনের আটজন ততক্ষণে গাঁজা আর দেশি-বিদেশি মিলিয়ে টেনে এসেছে গাঁ থেকে। তারাই নিলো ঠাকমার দায়িত্ত্ব। ঠাকমার শবাধার চারজন নেশাতুরের দোদুল্যমান চলন শুরু হলো যে নিমতলার মাটিতে সেথায় শবাধার নামাবার নিয়ম ছিল না। কিন্তু ঐ যে অভিজ্ঞ লোকের অভাব! হাত বদল বা কাঁধবদলেরও যে নিয়ম আছে ভায়া। অতিদ্রুত হাঁটছিল চারকাঁধের চারজন যুবক। বাকি আটজন সেই ঠাণ্ডার রাতে কম্বল মাফলার মোজা টুপি সোয়েটারের স্তূপের ভেতর ঘেমে উঠছিল এদের সঙ্গে হেঁটে।আকস্মিক গঙ্গাটিকুরি গ্রাম পার হয়ে মাসিসাঁকোর কাছে আসতেই চারকেঁধোর নেশা গেল ছুটে। আবার কাঁধবদল ঘটল। এক্ষেত্রে নামাতে হয় শবদেহকে। নামাতে হল। চারদিক কুয়াশাঘেরা শুনসান মাঠ। কোথাও কোনো গ্রামের রেখা নাই এখানে। কাছাকাছি চার কিলোমিটারের মধ্যে বাড়ি পাবেন না। এদিকে নিজের হাত পা দেখা যায় না কুয়াশায়। নেপাল মোড়ল তারমধ্যে পিঠের বস্তা থেকে দেশি বোতল বার করে ঢক্‌ ঢক্‌ করে যেই ঢেলেছে দু’ঢোক, অমনি মধু পাল দেদার খিস্তি আরম্ভ করে দিল। কারণ, আর ক’কদম গেলেই যে শ্মশানের দুর্গমপথ। বিভীষিকাময় পরিবেশে পড়বে সবাই। তাই সচেতন করতে একমাত্র কেঁধোপতি মধু পাল রেগে উঠল।

 

সেদিন ভালো দিন বা রাত ছিল কি-না জানা নাই। কিন্তু শ্মশানে যেতে গ্রামের সবকটা যুবকের চোখমুখ বেঁকে গেল।এমন বিভীষিকার রাত যে তাদের কপালে অপেক্ষা করছিল তা জানা ছিল না তাদের। কোথাকার এক বীরাচারি সাধক না-কি বিকাল থেকে অপেক্ষা করছিল মৃতদেহের জন্য। কিন্তু ওয়েদার ভালো বলে উদ্ধারণপুরের মত শ্মশানেও কোনো মড়া আসে নাই, এই রাত দশটা পর্যন্ত। ঠাকমা যেতেই বারোজন কেঁধো সহ ঠাকমার শবাধারকে বেঁধে ফেলে বীরাচারি।এদিকে ফাঁকা শ্মশান। এমনটা এখানে হবে কেউ ভাবতেই পারে না।সবসময় প্রচুর বডি থাকে, থাকে লোকজন। কিন্তু সেরাতে তাই ঘটেছিল। বারোজন কেঁধোকে একটা গণ্ডিতে আটকে বীরাচারি শুরু করে কাজ। একবার চিতায় ওঠে তো একবার লাফিয়ে গঙায় ঝাঁপ দিয়ে স্নান করে আসে। এসব দেখতে দেখতে তাজ্জব বনে যায় কেউ, ঘুমিয়ে যায় অনেকে। রাত তখন প্রায় দেড়টা হবে। দাউ দাউ জ্বলছে চিতা। চিতার ওপর দাঁড়িয়ে বামুন ঠাকমা। কালো শীর্ণ দু’হাত আকাশের দিকে তুলে আছে।মুখের ফর্সা রঙের জায়গায় কালো গর্ত। সেখানে আগুন শুধু। ঠকামা আগুন খাচ্ছে, না-কি আগুন ঠকামাকে খাচ্ছে! নিচে বীরাচারি মন্ত্রপাঠ করে যাচ্ছে।

লিখেছেন : ডঃ শান্তনু চট্টোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক

কেঁধোরা, যারা দাহকাজ করতে এসেছিল তারা চুপচাপ শ্মশানের মাটিতে শুয়ে বসে। ঠাকমাকে জ্বলন্ত চিতায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্যাবাচেকা খেয়ে আর্তনাদ জুড়ে দিয়েছে। শ্মশানের শিয়ালগুলো সারারাত চিৎকার করছিল। শ্মশানের শিমুলগাছে শকুনছানাদের কান্না-তো আগেই শুনেছে সবাই। চিতাকাঠের আগুন ভাঙার শব্দ আর ঠাকমার সেই দাঁড়িয়ে থাকার সঙ্গে বীরাচারির মন্ত্রপাঠে কেঁধোরা দেখতে পেলো একে একে জড়ো হচ্ছে শববাহীর দল। সেই রাতেই! দূর দুরান্ত থেকে জড়ো হলো পাঁচ ছয়টি মৃতদেহ। উদ্ধারণপুরের শ্মশান মুহূর্তে লোকে লোকে ভরে গেল যেন। বীরাচারি আনন্দে আবেগে চিৎকার করতে শুরু করলেন- ‘শবাকারে শক্তিরূপে শক্তিস্থে শক্তিবিগ্রহে শাক্তাচার প্রিয়ে দেবি…’।

রাত তখন প্রায় আড়াইটা। ঠাকমার অন্ত্যেষ্টি শেষ করেও বারোজন কেঁধোর কারোর সাহস বা ইচ্ছা হয়নি উদ্ধারণপুরের শ্মশান ছেড়ে বেরিয়ে আসতে। আহা, চার-চারটি চিতার আগুনগরম উষ্ণতায় শরীরে উত্তাপ ছেড়ে কে আর ঠাণ্ডা মাঠে প্রাণ বাঁচাতে আসে! শীতের রাতে চিতার উত্তাপ ভয়ের থেকেও আরামদায়ক যে।

Next Post

বাগান থেকে চা পাতা চুরি দুষ্কৃতীদের, পথ অবরোধ চাষিদের

Sun Oct 4 , 2020
Share on Facebook Tweet it Share on Reddit Pin it Share it Email নিউজ ডেস্ক , চোপড়া , ০৪ অক্টোবর : রাতের অন্ধকারে বাগান থেকে চুরি হয়ে যাচ্ছে কাঁচা চা পাতা। পুলিশ প্রশাসনকে একাধিকবার জানিয়েও সুরাহা হয় নি বলে অভিযোগ। তার প্রতিবাদেই রবিবার আন্দোলনে নামেন চা চাষিরা। এদিন উত্তর দিনাজপুরের […]

আপনার পছন্দের সংবাদ

RCTV Sangbad

24/7 TV Channel

RCTV Sangbad is a regional Bengali language television channel owned by Raiganj Cable TV Private, Limited. It was launched on August 20, 2003, as a privatecompany. The channel runs a daily live broadcast from Raiganj, West Bengal. The company also provides a set-top box.

error: Content is protected !!